০৫ ছোট্ট যে বাংলো

 ছোট্ট যে বাংলো বাড়িটাতে বাস করে বিলি আর তার মা, এই এলাকার সবচেয়ে পুরানো বাড়ি ওটা। রঙ চটে গেছে বহুকাল আগে। কাত হয়ে পড়েছে একপাশে। সামনের সিঁড়ির তিনপাশ ঘিরে আগাছা জন্মেছে। ড্রাইভওয়েটা ঘাস আর আগাছায় ঢেকে গিয়ে চেনাই যায় না। বাড়ির সামনে সুপ হয়ে আছে জঞ্জাল।

বাড়ি ফিরে বিলি দেখল তন্ময় হয়ে টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। তার মা। নিজের সমান লম্বা একটা কাউচে কনুইয়ে ভর দিয়ে কাত হয়ে শুয়েছেন। টক-শো হচ্ছে টিভিতে। গভীর মনোযোগে ওদের বাদানুবাদ শুনছেন তিনি।

দরজায় দাঁড়িয়ে মুচকি হাসল বিলি। পর্দার দিকে বিশেষ দৃষ্টিতে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে চ্যানেল বদলে গিয়ে দেখা গেল এমটিভি।

ঝটকা দিয়ে ফিরে তাকালেন মা। চিৎকার করে বললেন, রিমোট টেপাটেপি করছিস কেন? দে আগেরটা!

গায়ে শক্ত কি যেন লাগল তার। চোখ নামিয়ে দেখেন রিমোটটা তাঁর পাশে কাউচেই পড়ে আছে। বিস্মিত চোখ তুলে তাকালেন ছেলের দিকে।

বিলি তখন টিভির দিক থেকে নজর সরিয়ে নিয়েছে। চকোলেট মিল্কের একটা ব্যাগ কাটতে ব্যস্ত। রিমোট টিপে অনুষ্ঠান আবার আগের চ্যানেলে ফিরিয়ে আনলেন মা।

কি যে ছাইপাশ দেখো তুমি, মা, বিলি বলল। যত সব ছাগলের দল!

ছাগল হোক আর যাই হোক, টেলিভিশন তো ওদেরকে দাওয়াত করে নিয়ে যায়, কাটা জবাব দিলেন-মা। তোকে তো নেয় না।

ছাগলে ছাগল চেনে, পাগলে পাগল, যেন কি একটা মস্ত রসিকতা করে ফেলেছে ভেবে খিকখিক করে হাসতে লাগল বিলি। বিশ্রী ভঙ্গিতে শব্দ করে ঢেকুর তুলল।

মাথা নাড়তে নাড়তে মা বললেন, ভদ্ৰব্যবহার করতে পয়সা লাগে না, বিলি। তুই আর মানুষ হবি না কোনদিন। কোন মেয়ে তোর এই জঘন্য ঢেকুর। তোলা সহ্য করবে?

যে করবে, তাকে দেখলে তোমার জবান বন্ধ হয়ে যাবে, মা।

ছেলের দৌড় জানা আছে মায়ের। তার কথাকে গুরুত্বই দিলেন না। আবার মনোযোগ ফেরালেন টেলিভিশনের দিকে।

মা যতই খোঁচা দিয়ে কথা বলুক, ভাবছে বিলি, টেলিভিশনের ওই গর্দভগুলোর দলে কোনদিন যোগ দেব না আমি। ওদের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতা আমার, অনেক বড় কাজ করতে পারি। সারা পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিতে পারি।

মনে মনে নানা রকম পরিকল্পনা করতে লাগল বিলি। সবগুলোই মিলিকে জড়িয়ে। ওকে বাদ দিয়ে কোন কিছু করার ইচ্ছে নেই তার। মিলি তার সঙ্গে অন্য মেয়েদের মত খারাপ আচরণ করে না। তাকে অবহেলা করে না। এড়িয়ে চলে না। তাকে বোকা বলে না। তার রসিকতায় হাসে। তার খাতায় ভাল ভাল কথা লিখে দেয়। তাকে উৎসাহ দেয়। তাকে যে পছন্দ করে, তার জন্যে মায়া আছে, তার খারাপ কিছু হলে কষ্ট পাবে, এটা স্পষ্টই বুঝিয়ে দেয়। তাকে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়।

দরজায় টোকার শব্দ ভাবনার জগৎ থেকে ফিরিয়ে আনল বিলিকে। বিশেষ ধরনের পরিচিত টোকা। পটেটো এসেছে। দরজা খুলতে যাওয়ার আগে টেলিভিশনের দিকে তাকাল বিলি আরেকবার। মুহূর্তে হট্টগোল শুরু হয়ে গেল তাতে। ছবি ঠিকই থাকল, শব্দ হয়ে গেল গোলমেলে। কিছু বোঝ যায় না। মুচকি হাসল সে। গেল বিরক্তিকর গাধাগুলোর বকবকানি।

মা কিছু বলার আগেই ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল সে। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে পটেটো। ঠোঁটে আঙুল রেখে তাকে এখানে কথা না বলতে ইশারা করল। নেমে গেল আঙিনায়।

 পিছন পিছন গেল পটেটো। বললে বিশ্বাস করবে না, বিলি। আজ কারা এসেছিল আর্কেডে, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না!

অনুমান করতে বলছ? গোয়েন্দা।

থমকে দাঁড়াল পটেটো। কি করে জানলে?

 গ্যারেজেও হানা দিয়েছিল ওরা।

তোমাকে খুঁজে বের করল কিভাবে?

সেটাই তো আমি জিজ্ঞেস করতে চাই তোমাকে! কঠিন হয়ে উঠল বিলির কণ্ঠ। নিশ্চয় কোন ফাঁকে ভুল করে আমার নামটা বলে দিয়েছ ওদের কাছে।

হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল বিলি। ওর সঙ্গে তাল রাখতে হিমশিম খেয়ে গেল পটেটো।

না না, আমি একবারও তোমার নাম বলিনি। সত্যি।

মাঠে বেরিয়ে এসেছে ওরা। বিলিদের বাড়ির পেছনের তৃণভূমিটা বছরের এসময়ে সবুজ ঘন ঘাসে ভরা থাকে। এক সময় এটা ফক্স পরিবারের সম্পত্তি ছিল, বিলির দাদার। কিন্তু পরে হাতছাড়া হয়ে যায়। যেমন করে সব কিছু খুইয়েছে ওরা।

কাঁটাতারের বেড়াটা লাফ দিয়ে পেরিয়ে এল বিলি। তারের মাঝের ফাঁক দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করতে লাগল পটেটো।

থাকো ওখানেই! বিলি বলল।

 ঢাল বেয়ে পাহাড়ে উঠতে শুরু করল সে।

পটেটো ভাবল ওর ওপর রেগে যাওয়ায় ওকে সঙ্গে যেতে মানা করছে বিলি। সত্যি বলছি, বিলি, আমি কিছু বলিনি। তোমার কোন ক্ষতি কি আমি করতে পারি?

পাহাড়ের ওপরে ছোট একটা চত্বরমত জায়গা আছে। ঘাস খেতে খেতে ওখানে উঠে যায় গরুর পাল। রাতে বেশির ভাগ নেমে আসে। কিছু কিছু বেশি দুঃসাহসী গরু আছে, বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না, রাতেও থেকে যায় ওখানেই। গরু কি করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমায়, ভাবতে অবাক লাগে বিলির।

তুমি চলে যাও, পটেটো, ফিরে তাকিয়ে বলল বিলি। আমার এখন কাবাব খেতে ইচ্ছে করছে।

 ভারী দম নিল পটেটো। কাঁপা গলায় বলল, এখন? না না বিলি, গরু ঝলসানোর সময় এটা নয়!

 জবাবে হা-হা করে হাসল বিলি। যাও, চলে যাও। প্র্যাকটিসটা চালু রাখতে হবে আমাকে। নইলে শেষে দেখা যাবে অস্ত্র ভোতা হয়ে গেছে। ঠিকমত কাজ করছে না আর।

প্লীজ, বিলি, এখন ওসব করতে যেয়ো না!

ওর কাকুতি-মিনতিতে কান দিল না বিলি। আবার হেসে উঠল। সে কিছু করতে গেলে পটেটোর এভাবে বাধা দেয়া দেখে মজা পায়।

মানুষের সাড়া পেয়ে এক এক করে জেগে উঠতে শুরু করেছে গরুগুলো। বাবা করে ডাকছে। বুঝতেই পারছে না কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে, ওদের ভাগ্যে।

পটেটোর কাছ থেকে সুরে এসেছে বিলি। পাহাড়ের ওপরে উঠে। আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকাল। মেঘ জমেছে। তারা ঢেকে দিচ্ছে। ঝোড়ো বাতাস বইতে শুরু করল। পা ফুলে উঠল মেঘ। ঘন নীল, হয়ে গেল রঙ। বিদ্যুৎ-শক্তিতে বোঝাই। প্র্যাকটিস করার উপযুক্ত সময়।

 হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুনতে পাচ্ছি আমি, আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করল বিলি। আমি রেডি। চলে এসো!

আরও ছড়িয়ে পড়ল মেঘ। সব তারা ঢেকে দিল। ঝোড়ো বাতাসের গর্জনের মাঝে গরুগুলোর ডাকাডাকি বেড়ে গেল। আকাশের অনেক উঁচুতে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঘন ঘন।

আমি এখানে! চিৎকার করে বলল বিলি। এই যে এখানে! পারলে এসে ধরো আমাকে! বলেই যতটা জোরে সম্ভব দৌড়াতে শুরু করল সে। গরুগুলোর মাঝখানে চলে এল।

কই আসছ না কেন? আকাশের দিকে তাকিয়ে আরও জোরে চিৎকার করে উঠল সে। এসো! ধরো আমাকে!

দুই হাত ছড়িয়ে দিয়েছে সে। তাকিয়ে আছে রেগে যাওয়া মেঘের দিকে। বা এসো এসো! ধরো। আমি অপেক্ষা করছি! ওপর দিকে দুই হাত তুলে দিল সে। এসো! ধরো আমাকে।

বিলি দেখেছে, এভাবে ওপর দিকে হাত তুলে দিলে বিদ্যুৎ ছুটে আসে তার দিকে। বাড়ির ছাতে বসানো দণ্ডের মত আকর্ষণ করে সে বিদ্যুৎকে।

ফেটে পড়ল যেন আকাশটা। কোটি কোটি সাপের আঁকাবাকা জ্বলন্ত লেজ সৃষ্টি করে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল বিদ্যুৎ-শিখা। বজ্রপাত ঘটতে লাগল ধরণী কাঁপিয়ে।

অন্যান্যবারের মত এবারেও ব্যতিক্রম ঘটল না। বিদ্যুৎ-শিখা ছুটে ছুটে আসতে লাগল তার দিকে। গরুগুলোর মাঝখান দিয়ে ছুটে বেড়াতে লাগল সে। বিদ্যুৎ তাকে ধরতে না পেরে যেন প্রচণ্ড আক্রোশে গরুগুলোকে আঘাত হানতে লাগল। ভয়ে চিৎকার শুরু করেছে ওগুলো। বজ্রপাতে ঝলসে যাচ্ছে। মাংসপোড়া দুর্গন্ধে ভরে গেল বাতাস।

একটা বজ্র আঘাত হানল বিলিকে। শিরা বেয়ে তীব্র গতিতে বিদ্যুৎ ছড়িয়ে গেল সারা শরীরে। হাতের আঙুলের মাথা দিয়ে ছড়ছড় করে ছিটকে বেরোতে লাগল স্ফুলিঙ্গ। পায়ের পাতা আর আঙুল বেয়ে নেমে গেল মাটিতে।

পড়ে গেল বিলি।

 থেমে গেল বজ্রপাত, কমে এল বিদ্যুৎ চমকানো।

মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে বিলি। যেন অগ্নিপরীক্ষায় ক্লান্ত। দেহটা অসাড়। হাত-পা ঠিকমত নড়াতে পারছে না। অন্য কোন মানুষ হলে পুড়ে ছাই হয়ে যেত। বিলির কিছু হয়নি। তবে প্রচণ্ড ইলেকট্রিক শক সামলে নিতে কিছুটা সময় লাগবে।

দূর থেকে এতক্ষণ এই ভয়াবহ দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছে পটেটো। দৌড়ে এল কাছে। পড়ে থাকা দেহটার ওপর ঝুঁকে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চাইল, বিলি! তুমি ঠিক আছ তো? বিলি!

খবরদার! ধোরো না এখন আমাকে! ফোঁস করে উঠল বিলি। উঠে বসল। ওর কানের দুল, দাঁতের গর্ত ভরাট করা ধাতুতে এখনও স্পার্ক করছে। বিদ্যুৎ। শরীরের মধ্যে বিদ্যুৎ জমে আছে। বাতাসে বিদ্যুতের গন্ধ।

খুব ভাল আছি, হাসিমুখে জবাব দিল সে।

.

০৬.

 একটা মরা গরুর সামনে এসে দাঁড়ালেন শেরিফ রবার্টসন। হতভাগ্য প্রাণীটার খোলা নিষ্প্রাণ দুই চোখে এখনও মৃত্যুক্ষণের বিস্ময়ের ছাপ প্রকট। ওটার সামনে থেকে সরে গিয়ে সেলুলার ফোন তুলে কানে ঠেকালেন। হিলটাউন শেরিফ ডিপার্টমেন্টে মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতি সরিয়ে কিছু কিছু যেসব আধুনিক জিনিস ঢোকানো হচ্ছে, এই ফোনটা তার একটা।

পুরানো বন্ধু অস্টারিয়ান লাইটনিং অবজারভেটরির প্রোজেক্ট ডিরেক্টর হোমার বেলের সঙ্গে কথা বলছেন তিনি। গতরাতের বিদ্যুৎ-ঝড় সম্পর্কে শেরিফকে বিস্তারিত জানাচ্ছেন বেল।

 হুঁ-হাঁ করে করে বেলের কথার জবাব দিচ্ছেন শেরিফ। এই সময় একটা খয়েরি রঙের সীডান গাড়ি এসে থামতে দেখলেন।

ফ্যাক্স করে আমার অফিসে পাঠিয়ে দিতে পারবে? গোয়েন্দাদের দিকে চোখ রেখে ফোনে বললেন শেরিফ। পারলে এখনই পাঠাও। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে, হোমার। রাখি?

সুইচ টিপে লাইন কেটে যন্ত্রটা পকেটে রেখে দিলেন শেরিফ। কাত হয়ে আরেকটা মরা গরুর পাশ কাটিয়ে গাড়িটার দিকে এগোলেন।

গাড়ি থেকে নেমে আসছে তিন গোয়েন্দা।

আরও একটা গরুর পাশ কাটালেন শেরিফ। মাছি ভনভন করছে এটার  ওপর।

ছেলেগুলোর মুখোমুখি হতে অস্বস্তি বোধ করছেন তিনি। এরকম ঝামেলায় আর জীবনে জড়াননি। হিলটাউনে অপরাধ খুব কম হয়। মাঝেসাঝে দুচারটে মাতলামি, ঠগবাজি আর ছিঁচকে চুরির ঘটনা ছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছুই ঘটে না। বড় বড় চুরি-ডাকাতি ঘটার মত সম্পদ নেই শহরটাতে।

ঢাল বেয়ে উঠে আসতে আসতে ওপর দিকে তাকাল কিশোর। কোমরে হাত দিয়ে ওদের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন শেরিফ। এমন ভঙ্গি করে আছেন কেন? অস্বস্তি বোধ করছেন নাকি?

এগিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়াল কিশোর।

 শেরিফ বললেন, খবর তাহলে পেয়ে গেছ?

হেসে মাথা ঝাঁকাল কিশোর। কি দেখলেন? বজ্রপাতেই মারা গেছে?

কেন, অন্য কিছু আশা করেছিলে নাকি?

পত্রিকাওলারা তো বজ্রপাতে মারা যাওয়ার কথাই লিখেছে, ঘুরিয়ে জবাব দিল কিশোর।

মাথা ঝাঁকালেন শেরিফ। আঙুল তুলে দেখালেন। পাহাড়ের ওপরের ঘাসে ঢাকা চত্বরে তিনটে গরু মরে পড়ে আছে।

এগিয়ে গিয়ে ভাল করে দেখল কিশোর। প্রতিটা গরুর শরীর ঝলসে গেছে। রস মত বেরোচ্ছে। ফিরে এসে বলল, তারমানে আসল বজ্রপাতেই মারা গেছে এগুলো, বিড়বিড় করল সে। শেরিফের দিকে তাকাল, রিমোট কন্ট্রোলড নয়।

মাথা দুলিয়ে বললেন শেরিফ, তাই তো মনে হয়। অবজারভেটরির। হোমার বেলের সঙ্গে কথা বললাম এইমাত্র। ওই বনের ওপাশে মাইলখানেক দূরে ওটা।

 ফিরে তাকাল কিশোর। যেন গাছপালার মধ্যে কোথায় লুকিয়ে আছে। অবজারভেটরিটা দেখতে চায়।

বজ্রপাতের কথা কিছু বলেছে?

বলেছে। কাল রাতে বেশ কিছু বাজ পড়েছে এই পাহাড়ের ওপর। পৃথিবীর যে কোন জায়গার যে কোন বজ্রপাতের ঘটনা ধরা পড়ে ওদের যন্ত্রে। রেকর্ড থেকে যায়। বিদ্যুৎ চমকালে একটা নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে বেতার তরঙ্গ ছড়িয়ে দেয়,

শুম্যান রেজোন্যান্স বলে একে, শেরিফের মুখ থেকে কথাটা প্রায় কেড়ে নিয়ে বলল কিশোর। বিজ্ঞতা জাহির করে আনন্দ পেতে দিল না তাঁকে। প্রতি সেকেন্ডে আট সাইকেল। সাধারণ ট্রানজিসটর রেডিও দিয়েও ধরা। যায়।

চুপ হয়ে কিশোরের দিকে তাকিয়ে আছেন শেরিফ। এই ছেলেটার সঙ্গে সতর্ক হয়ে কথা বলতে হবে। এ ডক্টর এলিজা নয়। কখন লজ্জা দিয়ে দেবে। কে জানে!

হেসে খোঁচাটা দিয়েই দিল কিশোর, দেখলেন তো, আমি হোমওয়ার্ক ঠিকমতই করি।

হেসে ফেললেন শেরিফ। কাল রাতে যে সাধারণ বজ্রপাতেই মারা গেছে গরুগুলো, এ ব্যাপারে সন্দেহ থাকার কারণ নেই।

তারমানে সন্দেহ আছে আপনার?

দ্বিধা করলেন শেরিফ, একটা ব্যাপারেই খটকা লাগছে–একসঙ্গে একই জায়গায় এতগুলো বাজ পড়ল কিভাবে? অবস্থা দেখে মনে হয় যেন কেউ ওগুলোকে ঠিক এখানেই পড়তে বাধ্য করেছিল!

কয়েক গজ সরে গিয়ে একটা সমতল জায়গায় দাঁড়ালেন তিনি। ঘাস ওখানে পাতলা। হাত নেড়ে ডাকলেন, এসো, দেখে যাও।

এগিয়ে গেল তিন গোয়েন্দা।

আঙুল তুললেন শেরিফ। জুতোর খোঁচায় সরিয়ে দিলেন খানিকটা জায়গার বালি।

একসঙ্গে ঝুঁকে তাকাল মুসা, কিশোর আর রবিন।

দেখেছ? কালো একটা জিনিস পা দিয়ে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন শেরিফ, বলো তো এটা কি? ভাবলেন, এটার জবাব অন্তত দিতে পারবে না। কিশোর। চোখে চ্যালেঞ্জ নিয়ে মাথা তুলে হাসিমুখে তাকালেন ওর দিকে।

আরেকটু নিচু হয়ে ভাল করে দেখল কিশোর। মুখ তুলে বলল, ফুলগারাইট। তাই না?

হাসি চলে গেল শেরিফের মুখ থেকে। এটাও জানো!

নিরীহ কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর, বজ্রপাতে এরকম হয় বজ্র যেখানে পড়ে, প্রচণ্ড তাপে সেখানকার বালি গলে কাচ হয়ে যায়।

মাথা ঝাঁকালেন শেরিফ। উ?

 হাত দিয়ে ডলে কালো জিনিসটার ওপরের বালি সরাল কিশোর।

কি করছ?

 তদন্ত।

একটা মুহূর্ত চুপ করে রইলেন শেরিফ। তারপর বললেন, কিরতে থাকো। তবে এখানে নতুন আর কিছু পাবে বলে মনে হয় না। আমি যাই। আমার কাজ আছে।

বলে আর দাঁড়ালেন না তিনি। লম্বা লম্বা পায়ে হাঁটতে শুরু করলেন নিজের গাড়ির দিকে।

বসে পড়ল কিশোর। কালো জিনিসটার একপাশে আঙুল ঢুকিয়ে টেনে তোলার চেষ্টা করতে লাগল।

কি করছ? শেরিফের প্রশ্নটাই করল আবার রবিন।

সূত্র খুঁজছি?

 কিসের?

এখনও শিওর নই। দেখি আগে।

আর কিছু বলল না রবিন। মুসাও চুপচাপ দেখছে।

কালো, শক্ত কাচটা টেনে তুলতে গিয়ে খানিকটা ভেঙে ফেলল কিশোর। হাতে নিয়ে লেগে থাকা বালির কণা সরিয়ে চোখের সামনে এনে দেখতে লাগল। তারপর বাড়িয়ে দিল দুই সহকারীর দিকে, দেখো এখন। বজ্রপাতে বালি গলে কাচ হয়, এটা বৈজ্ঞানিক সত্য। কিন্তু কাচের মধ্যে মানুষের পায়ের ছাপ পড়ে, এটা কোন সত্য?

 খাইছে! বলো কি? ভুতুড়ে কাণ্ড নাকি? ভয়ে ভয়ে কাচটার দিকে তাকাল মুসা। হাতে নেয়ার সাহস করল না।

 কিন্তু রবিনের ওসব ভয় তেমন নেই। কাচটা নিয়ে দেখতে লাগল। কালো, পুরু কাচের মধ্যে সত্যিই একটা জুতোর ছাপ। জুতোর তলার সামনের অংশ। পুরোটাই পড়েছিল। পেছনটা রয়ে গেছে মাটিতে গেঁথে থাকা কাচের ভাঙা অংশে।

বিশ্বাস করতে পারছে না। হাত দিয়ে ডলে সরিয়ে দিতে চাইল ছাপটা। বুঝতে চাইল, সত্যি ছাপ, না কাচের গায়ে পড়া আলোর কারসাজি।

নাহ্, সত্যিই ছাপ! কোন সন্দেহই নেই আর তাতে।

এক কাজ করো না কেন? সহকারীদের দিকে তাকিয়ে বলল কিশোর। এটা নিয়ে কোন ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে চলে যাও পরীক্ষা করানোর জন্যে।

তুমি কি করবে?

বনের দিকে মুখ ফেরাল সে, অবজারভেটরিতে যাব।

.

০৭.

হিলটাউনের বজ্রপাত সম্পর্কে কিছু বলুন, স্যার, অনুরোধ করল কিশোর।

তেমন কিছু বলার নেই। সারা বছরই বজ্রপাত ঘটে এখানে। সময় অসময় নেই।

অস্টাডোরিয়ান লাইটনিং অবজারভেটরির পরিচালক ডক্টর হোমার বেলের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে কিশোর। পাহাড়ের ঢালে ওক বনের আড়ালে লুকিয়ে রাখা হয়েছে বিরাট বিল্ডিংটা। যেন বাইরের কেউ দেখে ফেললে কি জানি কি ক্ষতি হয়ে যাবে। চ্যাপ্টা, লম্বা বাড়িটার ছাতে রেডার অ্যান্টেনা আর মাইক্রোওয়েভ ট্রান্সমিটারের মিলিত চেহারার একটা যন্ত্র। বসানো। পুরো ছাতে খাড়া করে বসানো সারি সারি লাইটনিং রড।

ভেতরে বড় একটা সাজানো গোছানো ঘরে আলোকিত ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে শো করছে বিদ্যুতের ইতিহাস। যে কোন স্কুলছাত্র বিপুল আগ্রহ নিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে ঘরটার দিকে। তবে দেখার জন্যে ওদের যে ঢুকতে দেয়া হয় না, অনুমান করে নিয়েছে কিশোর। শেরিফ রবার্টসন সাহায্য না করলে সে নিজেও ঢুকতে পারত না।

 ধূসর হয়ে আসা চুলদাড়ির ফাঁক দিয়ে হাসি দেখা গেল ডক্টর বেলের। ঠোঁটে। সব সময় এখানকার আকাশে মেঘ জমে, মেঘের ফাঁকে বিদ্যুৎ চমকায়, শোনা যায় বজ্রের গুড়ুগুড়ু।

এর কারণ কি, স্যার?

ভুরু উঁচু করলেন বেল। সেটাই তো জানার চেষ্টা করছি আমরা। এত বেশি জমে কেন এখানে?

স্কাইলাইটের ভেতর দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল কিশোর। ছাতের কোন জায়গা বাদ দেয়া হয়নি। এমনকি স্কাইলাইটেও বসানো হয়েছে। লাইটনিং রড। কাচের ভেতর দিয়ে ছাতের বিরাট কিস্তৃত যন্ত্রগুলো চোখে পড়ছে।

এই রড বসানোর আসলেই কি কোন দরকার ছিল?

বজুকে বিশ্বাস নেই। কখন যে কোথায় গিয়ে পড়বে কেউ জানে না। যত বেশি রড লাগানো যাবে, ওগুলোর আকর্ষণে তত বেশি ছুটে আসবে। বজ্র। কেন ওগুলো ছুটে আসে, জানা সহজ হবে। কেউ কেউ জীবন্ত প্রাণীর সঙ্গে তুলনা করে একে। বলে, বজ্রের মন আছে, চিন্তা করার ক্ষমতা আছে।

ডিসপ্লের সামনে পায়চারি শুরু করলেন ডক্টর। তার পাশে হাঁটতে হাঁটতে নানা প্রশ্ন করতে লাগল কিশোর। নোটবুকে টুকে নিল। ডিসপ্লেতে। নানা ধরনের বজ্রের কথা লেখা আছে। মনোযোগ দিয়ে পড়ল সেগুলো।

নানা রকম যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে টেসলা কয়েল। বাতাস থেকে বিদ্যুৎ শুষে নেয়। আরেকটা আছে জ্যাকবৃস্ ল্যাডার। সমান্তরাল দুটো দণ্ডের একটা আরেকটাকে লক্ষ্য করে ক্রমাগত নীল বিদ্যুৎ ছুঁড়ে দিচ্ছে। এরকম একটা গবেষণাগারের পরিচালক হওয়ার জন্যে গর্ব বোধ করবেন যে কোন বজ্র বিজ্ঞানী। ডক্টর বেলও তাই করছেন।

ছাতের ওই যন্ত্রটা দিয়ে কি হয়, স্যার? জানতে চাইল কিশোর।

এক মুহূর্ত দ্বিধা করে জবাব দিলেন ডক্টর, কেমিক্যাল স্টোরেজ। ওয়েট সেল।

রীতিমত অবাক হলো কিশোর। মানে ব্যাটারি?

আঙুল তুলে ঘরের চারপাশটা দেখালেন ডক্টর। এখানকার সমস্ত যন্ত্রপাতি বস্ত্র থেকে শক্তি আহরণ করে চলে, কিশোর। ছাতের রডগুলোতে আঘাত হানে বজ্র। তাকে ধরে ফেলি আমরা। শক্তিটাকে জমিয়ে রেখে কাজে লাগাই। ধরার ব্যবস্থাটা এখনও নিখুঁত করতে পারিনি। তবে আশা করছি, করে ফেলতে পারব।

তার মানে আকাশের যে কোনখান থেকে বুকে টেনে আনার ব্যবস্থা করেছেন আপনারা। যদি কোন কারণে আপনাদের লাইটনিং রডে আঘাত না হানে বজ্র? অন্য কোনখানে গিয়ে পড়ে, তখন? মানে, আমি বলতে চাইছি, স্যার, অ্যাক্সিডেন্ট তো ঘটতেই পারে, তাই না?

প্রশ্ন শুনে আস্তে করে ডিসপ্লের দিক থেকে কিশোরের দিকে ঘুরলেন। ডক্টর। কিশোরের আপাদমস্তক দেখতে দেখতে চেহারায় ভাবের পরিবর্তন ঘটল।

দেখো, লোকে মনে করে আমরা এখানে বসে বজ্র তৈরি করি। যন্ত্রপাতিগুলোর সাহায্যে আকাশে মেঘ জমাই, সেটা থেকে বজ্র.. শান্তকণ্ঠে বললেন তিনি। কিন্তু আমরা সেটা করি না। আকাশে আপনাআপনি মেঘ জমে, বজ্র তৈরি হয়, আমরা সেটা নিয়ে গবেষণা করি মাত্র। বজ্রপাতে শুধু হিলটাউনেই নয়, সারা পৃথিবীতেই মানুষ মারা যায়। তাদের মৃত্যুর জন্যে যেমন আমরা দায়ী নই, হিলটাউনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনাগুলোর জন্যেও আমরা দায়ী নই। আমাদের অবজারভেটরি বসানোর বহু বহুকাল আগে থেকেই বজ্রপাত হত এখানে।

কিন্তু এখনকার মত এত নিশ্চয় হত না?

 থমকে দাঁড়ালেন ডক্টর বেল। ভুরু কোচকালেন। কি বলতে চাও?

 কিছু মনে করবেন না, স্যার। আমি বলতে চাইছি, আপনাদের। অবজারভেটরি কোনভাবে এখানকার আকাশে মেঘ জমানোয় সাহায্য করছে না তো? হয়তো তাতেই বজ্রপাত হচ্ছে বেশি বেশি…

মোটেও না! রেগে উঠলেন ডক্টর। বোঝা গেল, এই প্রশ্নের মুখোমুখি তাকে আরও বহুবার হতে হয়েছে। হিলটাউনের আকাশে সব সময়ই মেঘ। বেশি জমত, বজ্রপাত হত বেশি, সেজন্যেই অবজারভেটরি তৈরির জন্যে বেছে নেয়া হয়েছে এই জায়গা।

সরি, স্যার। আমি কিছু ভেবে ওকথা বলিনি…

আবার পায়চারি শুরু করলেন ডক্টর। নরম হলো না ভঙ্গি।

প্রসঙ্গ থেকে সরে যাওয়ার জন্যে বলল কিশোর, স্যার, বজ্রপাতে মারা। যাওয়া মানুষদের রেকর্ড রাখেন আপনারা?

কাধ ঝাঁকিয়ে প্রশ্নটাকে যেন ঝেড়ে ফেলে দিলেন ডক্টর। না, রাখি না। আমরা শুধু কবে কোথায় কতবার বজ্রপাত ঘটল, তার রেকর্ড রাখি। মানুষ মরল কি বাচল, সে-খবরে আমাদের কোন প্রয়োজন নেই।

তারমানে হিলটাউনে বজ্রাহত হয়ে কতজন বেচে গেল, সেটাও নিশ্চয়। বলতে পারবেন না?

ভুরু কুঁচকে ফেললেন বেল। সেটা জানলে কি লাভ হবে তোমার?

 দেখতাম আরকি, গায়ে বাজ পড়ার পরেও বেঁচে যায়, ওরা কেমন মানুষ?

কেমন আবার। তোমার আমার মতই স্বাভাবিক মানুষ।

কোনও অসাধারণ ক্ষমতা নেই ওদের বলতে চাইছেন?

নিরাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন ডক্টর, কিশোর পাশা, অযথা সময় নষ্ট করছ তুমি আমার। আমাদের এই প্রতিষ্ঠান একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার। ভুডু কিংবা ব্ল্যাক ম্যাজিকের আখড়া নয়।

একটা ব্রোঞ্জের মূর্তির দিকে তাকাল কিশোর। দেবরাজ জিউসের মূর্তি। হাতের দণ্ড থেকে বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গ ছুটছে। মিথলজি যদি বিজ্ঞান গবেষণাগারে থাকতে পারে ম্যাজিক থাকলে দোষ কি?–প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করল তার। বলল, আমিও বিজ্ঞানের কথাই বলছি, স্যার। জাদুবিদ্যা নয়। জানতে চাইছি, বজ্রপাতে আহত মানুষদের মধ্যে এমন কোন পরিবর্তন ঘটে কিনা, এমন কোন ক্ষমতা জন্মায় কিনা, যেটা বিস্ময়কর, অথচ তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে।

কাধ ঝাঁকালেন ডক্টর। শুন্যে দুই হাতের তালু চিত করে বললেন, ক্ষমতা জন্মায় কিনা জানি না, তবে বজ্রাহত হয়েও বেঁচে যায় কিছু কিছু মানুষ। বিদ্যুৎ সহ্য করার ক্ষমতা খুব বেশি ওদের। সব মানুষের সব কিছু সহ্য করার ক্ষমতা এক রকম হয় না। সহজ একটা উদাহরণ দিচ্ছি। পেটের কথাই ধরো। বাদুড়ের পোকা লাগা কাঁচা মাংস খেয়ে হজম করে ফেলতে দেখেছি– আমি অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীদের। তুমি-আমি কি সেসব খাওয়ার কথা কল্পনা করতে পারব? যদি বা গিলি, পেটে সহ্য হবে না। ফুড পয়জনিং হয়েই মরে। যাব। মানুষের নানা রকম সহ্য ক্ষমতার এমন ভুরি ভুরি উদাহরণ দেয়া যায়। তাই বলে ওদেরকে অস্বাভাবিক বলা যাবে না কোনমতেই।

আমিও ঠিক এই কথাটাই জানতে চাইছি, স্যার, নিজের ধারণার সঙ্গে মিলে যাওয়ায় খুশি হলো কিশোর। ওসব জিনিস গিলে হজম করতে পারাটাও একটা বিশেষ ক্ষমতা, এটা নিশ্চয় অস্বীকার করবেন না। নইলে আমি-আপনি পারি না কেন?

তা অবশ্য ঠিক। তবে ক্ষমতা না বলে একে অভ্যাস বললেই ঠিক হবে। আফ্রিকায় কিছু ওঝাকে দেখেছি, ভয়াবহ বিষাক্ত মাম্বা সাপের কামড়েও কিচ্ছু হয় না ওদের। জিজ্ঞেস করেছিলাম। প্রথমে মুখ খুলতে চাইল না। পরে বলল, ছোটবেলা থেকে, অল্প অল্প করে বিষ রক্তে ঢুকিয়ে সহ্য করতে করতে শেষে এমন সহ্যক্ষমতা জন্মেছে, কোন বিষেই আর কিছু হয় না। ঘড়ি দেখলেন ডক্টর বেল। তোমার আর কোন প্রশ্ন আছে?

না, স্যার। অনেক সময় দিলেন। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। চলি, গুডবাই।

দরজার দিকে পা বাড়াল কিলোর।

*

হুয়ারটন কাউন্টি বিল্ডিঙের ফরেনসিক ল্যাবরেটরির ওয়েইটিং রূমে বসে আছে মুসা আর রবিন। দুটো কারণে অপেক্ষা করছে–একটা, ফুলগারাইটের ছাঁচ শুকানোর। আরেকটা, কিশোরের আসার।

বার বার ছাঁচটার দিকে তাকাচ্ছে রবিন। টিপে দেখছে শক্ত হলো কিনা। মুসার দিকে ফিরে বলল, ভাল একটা সূত্র পাওয়া গেল।

তা তো গেল, মুসা বলল। কিন্তু এই সূত্র ধরে এগোনোর উপায়টা কি?

ঘরে ঢুকল কিশোর।

ফুলগারাইটের স্তর থেকে আস্তে করে ছাঁচটা টেনে খুলে আনল রবিন। চমৎকার একটা নকল তৈরি হয়েছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আধখানা জুতোর ছাপ। কিশোরকে দেখিয়ে বলল, অনেক তথ্য জমা হয়ে আছে এখানে, কি বলো?

একটা ব্রাশ দিয়ে ছাঁচের গায়ে লেগে থাকা আলগা প্লাস্টিক আর বালির কণা ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে বলল, দেখে মনে হচ্ছে স্ট্যান্ডার্ড মিলিটারি বুট। সাড়ে আট নম্বর।

ভুরু কোঁচকাল কিশোর। বিরাট পা।

কার, কিছু অনুমান করতে পারছ?

 কিশোর জবাব দেবার আগেই মুসা বলল, বিলি ফক্স?

সেই সম্ভাবনাই বেশি, কিশোর বলল। এখনই গিয়ে ওর জুতো পরীক্ষা করা দরকার।

.

০৮.

মহাসড়কের মাঝখানে একটা চৌরাস্তা। চারকোনাতেই ট্র্যাফিক লাইট আছে। গত কয়েক মাস ধরে অতিরিক্ত অ্যাক্সিডেন্ট হচ্ছে এখানে। কারণটা বুঝতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। মহাসড়কে সাধারণত একটানা দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে হঠাৎ ট্রাফিকপোস্টে লাল আলো জ্বলতে দেখলে থামতে চায় না। চালকেরা, কিংবা থামতে গড়িমসি করে। সেকারণে দুর্ঘটনা ঘটে অনেক সময়। কিন্তু এ হারে নয়।

সেদিনকার বিষণ্ণ, নিরানন্দ দিনটিতে দুটো গাড়ি ছুটে যাচ্ছে চৌরাস্তার দিকে। বাদামী ক্রাইসলার গাড়িটা দূর থেকেই সবুজ আলো দেখেছে। গতি না কমিয়ে ছুটতে থাকল। অন্য রাস্তা ধরে আসা নীল ইমপালাটাও সবুজ আলো দেখে গতি কমাল না। দুটো গাড়ির একজন চালকও লক্ষ করল না-করার কথাও নয়–চারটে পোস্টের সবুজ বাতিই একসঙ্গে জ্বলে উঠেছে।

তীব্র গতিতে চৌরাস্তার দিকে ছুটে গেল দুটো গাড়ি। পরক্ষণে নীরবতা খাখা হয়ে গেল টায়ারের তীক্ষ্ণ আর্তনাদে। সাই সাই স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে একে অন্যের পথ থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল।

বেঁচে গেল নেহাত ভাগ্যের জোরে। প্রায় গায়ে গা ছুঁয়ে পাশ কাটাল। একটা আরেকটার।

অই, পাগলের বাচ্চা পাগল! গাল দিল এক ড্রাইভার।

বাপের রাস্তা পেয়েছে? বলল আরেকজন।

দুই চালক খেঁকিয়ে উঠে যেন গায়ের ঝাল মেটাতে গাড়ি ছোটাল আরও জোরে।

আপনমনে হাসল বিলি ফক্স। একটা পরিত্যক্ত বাড়ির ছাতে উঠে ছাতের কিনারে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। এই লাল আর সবুজ আলোর খেলাটা ভিডিও গেমের চেয়ে তার কাছে অনেক বেশি মজার। মানুষকে ভড়কে দিতে পেরে। আনন্দ পায় সে। যাদের চমকে দিচ্ছে তারা প্রায় সবাই পরিচিত বলে মজাটা আরও বেশি।

সব মানুষকেই ভড়কে দিতে চায় না বিলি। যারা শত্রু, শুধু তাদের। ভয় দেখায় ওই সব সহপাঠীদের যারা ওকে নর্দমার কীট মনে করে। ওই সব দোকানদারদের, সে দোকানে ঢুকলেই যারা সন্দেহের চোখে তার দিকে তাকায়। ওই সব শহরবাসীদের যারা তার দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকায়, পেছনে আজেবাজে কথা বলে। ওদের কাউকেই ছাড়তে রাজি নয় সে। সুযোগ পেলেই ভোগাবে, এটা তার স্থির সিদ্ধান্ত। ভিডিও আর্কেডে পিজ্জাওলাটার হৃৎপিণ্ড কাবাব বানিয়েছে। একটা মথকে আগুনে পুড়তে দেখলে যতখানি দুঃখ হবে, সেটুকুও নেই তার জন্যে। সামান্যতম অনুশোচনা নেই।

গাড়ি দুটো কোনমতে বেঁচে চলে যাওয়ার পর অপেক্ষা করে বসে আছে সে, এই সময় পটেটোকে আসতে দেখল।

বাড়ির কাছে এসে ওপরে তাকিয়ে বিলি আছে কিনা দেখল পটেটো। তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসতে শুরু করল ওপরে।

জায়গাটা খুব পছন্দ বিলির। চারপাশে বহুদূর চোখে পড়ে। অনেক কিছু দেখা যায়। নিরিবিলি বসা যায়। তার নতুন আবিষ্কৃত এই খেলাটা এখানে বসার আনন্দ বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ।

রাস্তার দিকে তাকিয়ে আরও দুটো গাড়ি আসতে দেখল বিলি। নতুন মডেলের গাড়ি। নিশ্চয় অ্যান্টিলক ব্রেক। এ ধরনের ব্রেক কতটা কাজের পরখ। করে দেখা যাক, ভাবল সে।

পটেটো এসে বসল তার পাশে। কি খবর, দোস্ত? কি করছ?

কিছু না, রাস্তার দিকে তাকিয়ে জবাব দিল বিলি।

কিছু তো একটা করছই।

জবাব দিল না বিলি। চৌরাস্তার দিকে তাকিয়ে একটা মাইন্ড-পালস ছাড়ল। মনের জোরে ঘটনা ঘটানোর ব্যাপারটার নাম দিয়েছে সে মাইন্ড পালস। এরই সাহায্যে ট্র্যাফিক লাইটের লাল আলোকে সবুজ করে দেয় সে, সবুজ আলোকে লাল। দুদিক থেকে যে দুটো গাড়ি আসছে তার একটা জীপ, আরেকটা মিনিভ্যান। সবুজ আলো দেখে গতি কমাল না কেউ। একেবারে কাছাকাছি হওয়ার আগে কেউই বুঝতে পারল না যে অন্যজন গতি কমাবে না। সবুজ আলো দেখেছে দুজনেই, কমাবে কেন? একেবারে শেষ মুহূর্তে ব্রেক চেপে থেমে দাঁড়াল গাড়ি দুটো। বোঝা গেল কাজের জিনিস অ্যান্টিক ব্রেক।

বাইরে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে, পটেটো বলল। এটা শহর না ইঁদুরের গর্ত! বেরোনো উচিত আমাদের। আর ভাল্লাগছে না এখানে। চলো, লাস ভেগাসে চলে যাই। ধ্বংস করার… হেসে ফেলল পটেটো। তাড়াতাড়ি শুধরে নিয়ে বলল, মানে, আমি বলতে চাইছি, খেলার অনেক নতুন জিনিস পেয়ে যাবে ওখানে।

মাথা নাড়ল বিলি। লাস ভেগাসে যাচ্ছি না আমি। কোথাও যাব না মিলিকে ফেলে।

মিলির নাম উচ্চারণ করতেও ভাল লাগে তার। মনটা আনন্দে ভরে যায়।

মিলি, মিলি বলে বার বার চিৎকার করতে ইচ্ছে হয়।

বিলির দিকে তাকাল পটেটো। চোখ ঘুরিয়ে বলল, কি করে ভাবলে বললেই ও তোমার সঙ্গে চলে যাবে? স্কুলে ও তোমার দিকে তাকায় না। কথা বলে না।

কথাটা ঠিক। এ নিয়ে অনেক ভেবেছে বিলি। হতে পারে, স্কুলে অন্য কারও সামনে তার দিকে তাকাতে লজ্জা পায় মিলি। কত ধরনের লাজুক মেয়ে থাকে না। মিলিও হয়তো তেমনি। তার মানে এই নয় মিলি ওকে ভালবাসে না। অন্য কেউ সামনে না থাকলে তো কথা বলে। বলবে না-ই বা কেন? বিলি খারাপটা কিসে? স্বাস্থ্য ভাল না। ও অনেকেরই থাকে না। গরীব। সে তো পৃথিবীর বেশির ভাগ লোকই। কিন্তু তার মত অসাধারণ ক্ষমতা আর হকার আছে? এই ক্ষমতা ঠিকমত ব্যবহার করতে পারলে কোটিপতি হতে বেশিদিন লাগবে না।

স্কুলের কথা বাদ দাও, বিলি বলল। ওকে বোঝানো দরকার যে আমি ওকে ভালবাসি।

কি করে?

 চৌরাস্তার দিকে তাকিয়ে ভাবতে শুরু করল বিলি। কি করে মন জয় করা যায় মিলির? কি করে বোঝানো যায় সে একজন যোগ্য লোক? গাড়ির দিকে মন নেই আর তার। ট্রাফিক লাইটের দিকে তাকাচ্ছে না। বিড়বিড় করছে, ওকে বোঝাতে হবে ওকে আমি কতটা ভালবাসি। ওর কথা ছাড়া। আর কিচ্ছু ভাবি না আমি।

পটেটো প্রশ্নটা করায় খুশিই হলো বিলি। কি করে মিলিকে তার প্রতি আকৃষ্ট করা যায়, এই ভাবনাটা জোরাল হলো তার মনে।

পটেটোর প্রথম প্রশ্নটার জবাব এখনও দিতে পারেনি বিলি, আরেকটা প্রশ্ন তার পাতে তুলে দিল পটেটো, জনাব মজনু সাহেব, আরও একটা কথা–মিলি তোমার বসের মেয়ে। সেকথাটা ভুলে যেয়ো না।

পা তুলে হাঁটু ভাজ করে বসল বিলি। দুই হাত দিয়ে বুকের ওপর চেপে ধরল দুই পা। সেটা কোন সমস্যাই না।

কেন, সমস্যা নয় কেন?

ওটার ব্যবস্থা আমি করে ফেলতে পারব, কাঁধ ঝাঁকাল বিলি। দিলাম নাহয় ওর মনটাও ধ্বংস করে।

বিলির কথা ঠিক বুঝতে পারল না পটেটো। ওর মন? ও তোমার বস, বিলি…

মরে গেলেই ও আর আমার বস থাকবে না, খারাপ কথাটা এরকম করে বলতে চাইল না বিলি। কিন্তু পটোটোকে নিয়ে সমস্যা হলো ভেঙে না বললে ও কিছু বুঝতে পারে না। মন থাকে হৃৎপিণ্ডে। ওটা কাবাব বানিয়ে দেব। যাবে নষ্ট হয়ে। নিজের রসিকতায় মজা পেয়ে নিজেই হেসে উঠল।

আঁতকে উঠল পটেটো। পাগল নাকি! খবরদার, ওই টিকটিকিগুলোর কথা ভুলো না। ওদের ছোট করে দেখলে ভুল করবে। বিশেষ করে কোঁকড়াচুলোটাকে। ওর চোখ দেখেছ? চোখের দিকে তাকালেই ভয় লাগে। মনের ভেতর কি আছে সব যেন দেখতে পায়। মিস্টার হাওয়ার্ডের ক্ষতি করতে যাওয়া তোমার ঠিক হবে না, বিলি। আরেকটা কথা ভেবেছ? ওর। মেয়ে যদি বুঝে ফেলে তুমি ওর বাপকে খুন করেছ, কোনদিন আর ভালবাসবে? চরম ঘৃণা করবে তখন। বরং, অন্য কোনভাবে মিলির মন জয়। করার চেষ্টা চালাও।

ঠিক কথাই বলেছে পটেটো। কিন্তু কোন কিছু নিয়ে বেশি ভাবনা-চিন্তা করতে ভাল লাগে না বিলির। ঝট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ শেষ করে ফেলাই ওর পছন্দ। দেরি সহ্য হয় না। তবু এক্ষেত্রে চিন্তা এবং সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই।

মিলি সুন্দরী, পটেটো বলল, তা ছাড়া ধনীর একমাত্র কন্যা। ওর মত মেয়ে কোন গুণধর লোককেই বিয়ে করতে চাইবে।

পটেটোর চোখের দিকে তাকাল বিলি, আমার গুণ আছে।

চোখ সরিয়ে নিল পটেটো, হ্যাঁ, তা আছে।

দূরে পাহাড়ী রাস্তা বেয়ে একটা বড় ট্রাককে নেমে আসতে দেখা গেল। অন্যদিকে হিলটাউন পাস ধরে ছুটে আসছে একটা সাদা ফোর্ড গাড়ি।

বেশ, বিলি বলল, কতটা গুণ আর যোগ্যতা আমার আছে, মিলিকে দেখাব আমি।

মুখ ফেরাল পটেটো। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল বিলির দিকে। কি করে দেখাবে? গলা কাঁপছে ওর।

হাসল বিলি। আমার ক্ষমতা সম্পর্কে এখনও তোমার পুরোপুরি ধারণা নেই, পটেটো। অনেক কিছু করতে পারি আমি। রাস্তার গাড়িগুলোর দিকে চোখ ফেরাল সে। খেলাটা এখন আর খেলা নেই ওর কাছে, জরুরী কাজ হয়ে উঠেছে। ওর পরিকল্পনার একটা অংশ। একটা সাংঘাতিক পরীক্ষা। ভাবতে গিয়ে হাসি ছড়িয়ে পড়ল মুখে। এ পরীক্ষায় জয়ী হতে পারলে A+ দেয়া উচিত তাকে, ভাবল সে।

 মিলিও তখন বুঝে যাবে ওর ক্ষমতা। ওর যোগ্যতার প্রমাণ পাবে। ওর। প্রতি দুর্বল হয়ে পড়বে।

কাছাকাছি চলে এসেছে দুটো গাড়ি। ট্র্যাফিক লাইটের দিকে মন ফেরাল বিলি। মগজের কোন এক রন্ত্রে যেন নাড়ীর স্পন্দনের মত টিকটিক করে বাজতে শুরু করল একটা বিশেষ শক্তি। স্পষ্ট টের পাচ্ছে সে। অনুভব করতে পারছে। মাইন্ড-পালসকে কাজে লাগিয়ে ইচ্ছাশক্তির জোরে বিদ্যুৎ সঙ্কেত পাঠিয়ে দুদিকের লাল আলোকে সবুজ করে দিল। গুনতে শুরু করল: এক…দুই…তিন…

ধ্রাম!

প্রচণ্ড শব্দ। সাদা গাড়িটার পেটে গুলো মেরেছে ট্রাক। ডিগবাজি খেয়ে ঘুরতে ঘুরতে পথের পাশের খাদে গিয়ে পড়ল গাড়িটা। ট্রাকের ড্রাইভারও নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। এলোপাতাড়ি ছুটছে। ঝাঁকি লেগে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়তে লাগল ওতে বোঝাই বাঁধাকপি। একটা টেলিফোন পোস্টে তো খেয়ে অবশেষে থামল ওটা।

হেসে উঠল বিলি। আহ, কি খেলটাই না দেখাল! পায়ের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিল সে। উঠে দাঁড়াল। সত্যি দারুণ! এমনটা সচরাচর দেখা যায় না!

জোর করে হাসল পটেটো। না হাসলে যদি আবার বিলি রেগে যায়। কিন্তু খুশি মনে হলো না ওকে।

ওর বাহুতে থাবা মারল বিলি, কি ব্যাপার, খুশি না নাকি? দেখো, দেখে যাও। এমন খেলা পয়সা দিয়েও পাবে না।

জবাব দিল না পটেটো।

চলো, পটেটোর হাত ধরে টান দিল বিলি। কাছে গিয়ে দেখি।


Comments

Post a Comment